বুধবার, ০৬ নভেম্বর ২০২৪, ০৫:৫৭ পূর্বাহ্ন

করোনায় সরকারি স্কুলমুখী লটারিতে আশাভঙ্গ

করোনায় সরকারি স্কুলমুখী লটারিতে আশাভঙ্গ

স্বদেশ ডেস্ক :

বিগত বছরগুলোয় বেসরকারি স্কুলে সন্তানকে ভর্তি করতে উন্মুখ দেখা যেত অভিভাবকদের। বিপরীতে সরকারি স্কুলের প্রতি এক ধরনের অনীহা দেখা যেত অনেকের মধ্যেই। এবার করোনা ভাইরাসের কারণে সে ধারায় কিছুটা ছেদ পড়েছে। উপার্জন কমে যাওয়ায় নিম্ন মধ্যবিত্ত-মধ্যবিত্ত অনেকের পক্ষেই আর বেসরকারি স্কুলের খরচ বহন করা সম্ভব নয়। ফলে তারা ছুটেছেন সরকারি স্কুলে।

কিন্তু চাহিদার তুলনায় সরকারি স্কুল খুবই কম হওয়ায় ভর্তির সুযোগবঞ্চিত হয়েছে বিপুুলসংখ্যক শিক্ষার্থী। এ নিয়ে অভিভাবকদের মধ্যে ক্ষোভ বিরাজ করছে। তারা জনসংখ্যা অনুপাতে জেলা-উপজেলা পর্যায়ে আরও সরকারি স্কুল প্রতিষ্ঠার দাবি জানিয়েছেন।

করোনা সংক্রমণের কারণে গত বছরের নয় মাসই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল। এবার নতুন শিক্ষাবর্ষে সরকারি-বেসরকারি সব স্কুল লিখিত পরীক্ষার পরিবর্তে লটারির মাধ্যমে শিক্ষার্থী ভর্তি নিয়েছে। সংক্রমণ এড়াতে এটি করা হলেও ভাগ্যনির্ভর এ পদ্ধতিতে পছন্দের স্কুলে ভর্তি হওয়াটা সম্ভব হয়নি অনেকেরই। ব্যয় কমাতে যাদের প্রথম পছন্দ ছিল সরকারি স্কুল, তাদের বাধ্য হয়েই এখন বেশি খরচের বেসরকারি স্কুলে যেতে হচ্ছে। বিষয়টি অভিভাবকদের ওপর আর্থিক চাপের দুশ্চিন্তা বাড়িয়ে তুলেছে।

মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী ২০ জানুয়ারির মধ্যে সরকারি স্কুলগুলোয় ভর্তি কার্যক্রম শেষ করতে হবে। আর ২১ থেকে ২৫ জানুয়ারি পর্যন্ত অপেক্ষমাণ তালিকায় নির্বাচিত শিক্ষার্থীদের ভর্তি শেষ করতে হবে।

চলতি শিক্ষাবর্ষে সারাদেশের ৩৯০টি সরকারি স্কুলে ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত ভর্তির জন্য অনলাইনে লটারির মাধ্যমে শিক্ষার্থী বাছাই করা হয়। এসব স্কুলে ভর্তিযোগ্য শূন্য আসন ছিল ৭৭ হাজার ১৪০টি। এর বিপরীতে ভর্তির জন্য আবেদন করে ৫ লাখ ৭৪ হাজার ৯২৯ শিক্ষার্থী। অর্থাৎ প্রতি আসনের বিপরীতে সাতজনের বেশি আবেদন করে। লটারিতে প্রথমে ৭৭ হাজার ১৪০ জনকে বাছাই করা হয়। এর পর সমানসংখ্যক আবেদনকারীকে অপেক্ষমাণ তালিকায় রাখা হয়। কোনো কারণে প্রথম বাছাইয়ের শিক্ষার্থী নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ভর্তি না হলে অপেক্ষমাণ তালিকা থেকে ভর্তি নেবে স্কুলগুলো।

মহামারীতে আয়রোজগার কমেছে বেশিরভাগ অভিভাবকের। অন্যদিকে ন্যূনতম টিউশন ফি-ও মওকুফ করেনি স্কুলগুলো। পুরো বছরের ফি পরিশোধ করতে হিমশিম খেতে হয় তাদের। টিউশন ফি পরিশোধে সরকারি দায়সারা নির্দেশনা নিয়েও ক্ষুব্ধ তারা। অভিভাবকদের প্রশ্ন- চাহিদার তুলনায় কেন অপ্রতুল সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। বেসরকারি শিক্ষা বাণিজ্যের প্রতি সরকারি উৎসাহের অভিযোগ তাদের।

সরকারি বাংলাবাজার বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে লটারিতে ভর্তির সুযোগবঞ্চিত এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক আহসান উল্লাহ গতকাল শনিবার আমাদের সময়কে বলেন, করোনা মহামারীতে আমাদের আয়রোজগার কমে গেছে। এর পরও বেসরকারি স্কুলে কোনো টিউশন ফি মওকুফ করেনি। এখনো আমাদের আয়রোজগার স্বাভাবিক হয়নি। কিন্তু সন্তানের লেখাপড়াও চালিয়ে নেওয়া দরকার। কম খরচের জন্য এ বছর সন্তানকে সরকারি স্কুলে দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ভাগ্যে হলো না।

ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ষষ্ঠ শ্রেণি পড়–য়া এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক সৈয়দ আহমদ জানান, করোনার সময় আমরা সরকারের কাছে দাবি জানিয়ে ছিলাম টিউশন ফি মওকুফ করার জন্য। কিন্তু সরকার যে নির্দেশনা দিয়েছে তা খুবই দায়সারা। এখন পর্যন্ত কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান টিউশন ফি মওকুফ করেনি। মহামারীতে আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি সব পরিবারে কমবেশি হয়েছে। কিন্তু সরকার বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের পক্ষেই ছিল। ফলে বন্ধ থাকার পরও কোনো প্রতিষ্ঠানই টিউশন ফি মওকুফ করেনি। অভিভাবকদের ওপর নানাভাবে চাপ প্রয়োগ করে সব টাকা উসুল করেছে। সাধ্যের মধ্যে ব্যয়ের জন্য এ বছর আমার মেয়েকে সরকারি স্কুলে ভর্তির জন্য চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু লটারিতে হয়নি।

তেজগাঁও সরকারি বালক উচ্চবিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তিচ্ছুক এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক সোনিয়া বেগম অভিযোগ করেন, চাহিদা থাকার পরও সরকারি স্কুলের সংখ্যা কম। সরকার নতুন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান না করলে বিদ্যমানগুলোয় আসন বাড়িয়ে ভর্তি নিতে পারে। আমাদের মতো সাধারণ মধ্যবিত্তদের জন্য প্রতি মাসে ৫ হাজার থেকে ৮ হাজার টাকা টিউশন ফি দিয়ে বেসরকারি স্কুলে লেখাপড়া করাতে পারি না। আমার ছেলে লটারিতে সরকারি স্কুলে চান্স পায়নি। এখন কী করব?

এই স্কুলে ভর্তিচ্ছুক আরেক শিক্ষার্থীর অভিভাবক খাদিজা বেগম অভিযোগ করেন, চাহিদা থাকার পরও সরকারি স্কুল প্রতিষ্ঠা না করে বেসরকারি স্কুলগুলোকে শিক্ষা বাণিজ্যে উৎসাহ দিচ্ছে সরকার।

এ প্রসঙ্গে বুয়েটের কম্পিউটার প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ বলেন, করোনা মহামারী আমাদের নতুন করে ভাবিয়ে তুলছে। আমরা আগে অতিরিক্ত খরচ করতে তেমন একটা চিন্তা করতাম না। এখন খরচ করার আগে তিনবার চিন্তা করি। তেমনি অভিভাবকদের মধ্যেও একটা পরিবর্তন এসেছে, একসময় বেসরকারি স্কুলে ভর্তি ছিল সোনার হরিণ, এখন সরকারি স্কুলে ভর্তির নিশ্চয়তা হচ্ছে সোনার হরিণ। তারা ব্যয় হ্রাসের জন্য সরকারি স্কুলকে পছন্দ করছেন বেশি। শহর-গ্রামে জনসংখ্যার চাহিদার ভিত্তিতে সরকার নতুন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করতে পারে। পাশাপাশি বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রতিও সরকারি নজরদারি বাড়াতে হবে।

তিনি বলেন, দুর্যোগের সময়ে সরকার টিউশন ফি নিয়ে যে নির্দেশনা দিয়েছে তাতে অভিভাবক-শিক্ষা প্রতিষ্ঠান উভয়ের প্রতি করণীয় বলা ছিল। এক পক্ষের জন্য ছিল বলা যায় না। তবে মনিটরিং দরকার ছিল, যেটা সরকার করেনি। প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের জন্য টিউশন ফি মওকুফ করা না গেলে আর্থিক অনটনে এরা শিক্ষা থেকে ঝরে পড়বে।

এ বিষয়ে মাউশির মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. সৈয়দ মো. গোলাম ফারুক বলেন, সরকারি স্কুলের সংখ্যা গত ১০ বছরে দ্বিগুণ হয়েছে। এখন পুরো শিক্ষাব্যবস্থা জাতীয়করণের একটা দাবি উঠেছে বিভিন্ন মহল থেকে। অন্যদিকে সরকারের সামর্থ্যও আমাদের দেখা দরকার। পৃথিবীর সব দেশেই সরকারির পাশাপাশি বেসরকারি শিক্ষাব্যবস্থা আছে। অভিভাবকদের সামর্থ্য অনুযায়ী গন্তব্য হওয়া দরকার। লটারিতে সবাই চান্স পাবে, এমন তো নয়। এটি তো বাছাই প্রক্রিয়া।

সারাদেশে সরকারি স্কুল রয়েছে ৬৮৩টি। এর মধ্যে ৩৯০টি স্কুলে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তির জন্য অনলাইনে আবেদন ছিল ৪২ হাজার ৩৭২টি, দ্বিতীয় শ্রেণিতে ১২ হাজার ৬৮৫, তৃতীয় শ্রেণিতে ১ লাখ ৪৮ হাজার ১৯৪, চতুর্থ শ্রেণিতে ২২ হাজার ৯৬৮টি, পঞ্চমে ৩৬ হাজার ৭৩৪, ষষ্ঠ শ্রেণিতে ২ লাখ ৪৩ হাজার ৫১৬টি, সপ্তমে ১১ হাজার ৫৩১টি, অষ্টমে ২১ হাজার ৩৯৩ এবং নবম শ্রেণিতে ৩৫ হাজার ৫৩৬টি। বাকি ২৯৩টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ম্যানুয়্যাল পদ্ধতিতে লটারির মাধ্যমে শিক্ষার্থী বাছাই করা হয়।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877